◾আল মাহমুদের স্বাতন্ত্র্য।
আল মাহমুদ কেন আলাদা? কেন তাকে মনে রাখতে হবে? কিভাবে তিনি হাজার হাজার বছরের সাহিত্যযাত্রায় টিকে থাকতে পারেন?
না কি হারিয়ে যাবেন কোটি কোটি সাধারণ মানুষের মতো?
আর যদি না-ই হারিয়ে যান, তাহলে কেন-ই বা তাকে পাঠ করতে হবে? এসব প্রশ্ন হয়তো খুব সাধারণ কিংবা সাধারণ লোকে হয়তো এসব প্রশ্ন করে থাকে। কিন্তু উত্তর? উত্তরগুলো কিন্তু সাদামাটা নয় জটিল ও চিন্তাযুক্ত। কেন?
আল মাহমুদের সাহিত্যচর্চার দ্বিতীয় পর্যায় নিয়ে সকল সমালোচনা, নিন্দা ও অবহেলাকে সামনে রেখে যদি খুব খোলামেলাভাবে আলোচনায় অংশ নেয়া যায়, তাহলে দেখা যাবে তার কল্পনা ও পরিকল্পনা এবং প্রকাশের কৌশলে এমন কিছু বিষয় ও ভার রয়েছে, যা সাধারণ হয়েও অনন্য। বক্তব্যটিকে সরল করার জন্য কয়েকটি ধারণাকে আগে আলাদা করে সাজানো যেতে পারে- প্রথমে একটি বিশেষ প্রশ্নের দিকে দৃষ্টি দেয়া যায়- কেন আল মাহমুদ স্বতন্ত্র?
উত্তরটি হতে পারে এ রকম আলাদা এই কারণে যে ১. তিনি আদর্শ ও চিন্তার ব্যাপারে স্বচ্ছ; ২. তিনি সময় ও সমাজের স্বাভাবিক স্রোতে ভাসেননি; ৩. শিল্প ও সাধনার প্রতি তিনি আস্থাশীল; ৪. সত্য বলতে ও লিখতে তিনি দ্বিধা করেননি; ৫. বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ও লোকায়ত জীবনধারার প্রতি তিনি আন্তরিক।
অন্তত এই ৫টি কল্পবাক্যকে সামনে রেখেও যদি আল মাহমুদের কবিতা-কথাসাহিত্য ও গদ্যরচনাকে পর্যালোচনা করার চেষ্টা করা হয় এবং নিবিড়পাঠের ভেতর দিয়ে এগোতে হয়, তাহলে খুব সহজেই এবং সত্যি সত্যি এক আলাদা আল মাহমুদ সামনে এসে হাজির হবেন।
আদর্শে ও প্রকাশে তিনি প্রথমে ছিলেন বাম, পরে হয়েছেন ডান। নাস্তিকতা থেকে আস্তিকতায় এসেছেন। প্রসঙ্গত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী‘ গল্পের মকসুদের কথা যদি ধরা হয়, তাহলে কী দেখা যাবে? দেখা যাবে লেখক বলছেন : ‘বামপন্থী মকসুদ আজ একা।
তার বিশ্বাসের কাঁটাটি দুলতে দুলতে ডান দিকে এসে হেলে থেমে যায়।’ পেরুর নোবেল বিজয়ী কথানির্মাতা মারিও ভারগাস য়োসাকেও দেখা গেছে বাম থেকে ডান ধারায় আস্থাশীল হতে। এটাই হচ্ছে সমাজের বাস্তবতা। মানবজীবন এমনই। হাঁটুর জোর কমে এলে, চোখে ঝাপসা দেখতে শুরু করলে লোকেরা কেবলা-কাশি মুখী হয় মসজিদ-মন্দিরের দিকে ভিড় জমায়। আল মাহমুদের জীবনে সেটি হয়তো একটু আগে ঘটেছে। আর লোকেরা সাধারণভাবে নিজের ধারণা ও বিশ্বাস অনেক সময় লুকোয়।
কিন্তু মাহমুদ তা করেননি। কবিতা ও কাহিনি লেখার সময় তিনি নিজস্ব দর্শন ও বিশ্বাসকে কলম ও কাগজের ওপরে রেখেছেন। মার্কসবাদে ঝুঁকে পড়ার বিষয়ে তিনি বলেছেনঃ
‘বুঝে হোক না বুঝে হোক আমি মার্কসীয় চিন্তা-চেতনার ভেতর সমাজটাকে পাল্টে ফেলার একটা রঙিন স্বপ্নের দিকে ডানা মেলে দিলাম। না বুঝে বলছি, কারণ আমার তখন যে বয়স সে বয়সে আর যাই হোক দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ পরিপাক করার মত হজমশক্তি থাকার কথা নয়। (যেভাবে বেড়ে উঠি, ২০১১: ৭৫)
আবার দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনবোধের রূপান্তর সম্বন্ধে অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন এভাবে : ‘আমি জেলখানায় থাকাকালে ধর্মগ্রন্থগুলোর একটা তুলনামূলক পাঠ দেয়ার সুযোগ পাই এবং চরম নাস্তিকতার দিক থেকে আস্তিকতার দিকে ফিরে আসার অবকাশ সৃষ্টি হয়।’ (বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ, ২০০৭ : ১৩০) অবশ্য ধর্মবিশ্বাসের কারণে সমকালে তিনি নিন্দিত ও সমালোচিত হয়েছেন; আবার স্থির স্বীকৃতিও যে পাননি তা কিন্তু নয়। শিবনারায়ণ রায়ের একটি মন্তব্য এখানে তুলে দেয়া যায় ‘আল মাহমুদের স্বঘোষিত ধর্মবিশ্বাস বাংলাদেশের বেশকিছু উচ্চশিক্ষিত পাঠককে তার প্রতি বিমুখ করেছে। কোন কবির বিশ্বাসতন্ত্রকে অবশ্যই অগ্রাহ্য করা চলে না। (‘একজন খাঁটি কবি’, প্রেক্ষণ, ২০০৭ : ১৬৪)
কবি ও কথাশিল্পী আল মাহমুদ সময় ও সমাজের স্বাভাবিক প্রবাহে নিজেকে ভাসিয়ে দেননি। একটা প্রাতিস্বিক ব্যক্তিত্বে সব সময় উজ্জ্বল থেকেছেন। কি নতুন স্বাধীন বাংলাদেশের সামাজিক পরিস্থিতিতে, কি শিল্পকলায় চাকরি জীবনে, কি অনুকূলের কোনো রাজনৈতিক দলের রাষ্ট্রক্ষমতার সময়ে। নিন্দার বিপুল বহর কাঁধে নিয়েও টিকে গেছেন সময়ের প্রতিকূল বাতাসে।
যেহেতু তিনি নিজেও একটা প্রবল শক্তি, তাই তাকে অন্য কোনো শক্তির কাছে হার মানতে হয়নি। শৈশব-কৈশোরে বেড়ে ওঠার কালে পরিবার ও প্রতিবেশ থেকে বেঁচে থাকার যে আনন্দ ও প্রেরণা গ্রহণ ও ধারণ করেছেন, তার লালিত্যে আজীবন গুনগুন করে গেয়ে গেছেন জীবনের গান।
আর সে কারণেই তিনি তরুণ কোনো কবি কিংবা কোনো ভক্তের কাছে হাত বাড়িয়ে চেয়ে নিতে পেরেছেন সিগারেট, কোনো সাহিত্যসভা শেষে ঢাকার পথে কোনো অনুজ সাহিত্যিকের সাইকেলে চেপে বাড়ি ফিরতে সঙ্কোচ করেননি, কিংবা ৭০ বছর বয়সেও তাকে দেখতে-আসা কোনো ২১ বছরের তরুণীর চুলের প্রশংসা করে দ্বিধাহীনভাবে লিখে ফেলেছেন প্রেমের কবিতা।
শিল্পকে, সাহিত্যকে তিনি সাধনার মধ্যে রেখেছেন সব সময়। চিন্তার পরিবর্তন, রাজনৈতিক-সামাজিক প্রতিকূলতা কিংবা সাহিত্য-সমাজের নিন্দা কোনোটিই তাঁকে সৃজনশীলতা ও মননশীলতার পথ থেকে দূরে সরাতে পারেনি। কখনো কখনো যে বিপন্ন হননি, তা নয়; কিন্তু সাধনার ওপর ভর করে প্রাতিস্বিক ভুবনে প্রত্যাবর্তন করতে পেরেছেন। কি মার্ক্সীয় দর্শন, কি স্রষ্টামগ্নতা যে-কোনো ভাবনাপ্লাবনে তিনি সাহিত্যকে সবকিছুর ওপরে ধারণ করেছেন।
এখানে, পূর্বাপর তাঁর কবিতার নান্দনিকতা ও শিল্পময়তাকে স্পর্শ করার জন্য, ধর্মীয় ভাবধারার একটি কবিতা থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করা যেতে পারে ‘ইসরাফিলের চোখ দুটি ঈষৎ রক্তবর্ণ ধারণ করলেও অনন্তকালের মধ্যে তিনি সজাগ/ শৃঙ্গধারী এক ফেরেস্তা। তবুও তার চোখের কোল বেয়ে কিসের দুটি দাগ? তিনি কি/ তার প্রথম ফুৎকারের পরিণাম দর্শনে মুহূর্তের জন্যও কেঁদে ফেলেছিলেন? তার/ বৈদুর্যমণির মত চোখ দুটি থেকে কি ঠিকরে গড়িয়ে পড়েছিল বৃষ্টি?... ’ (‘পুনরুত্থানের ফুৎকার’)
আল মাহমুদের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো সত্য প্রকাশে কুণ্ঠাহীনতা। ধর্মীয় বিশ্বাস প্রচার ও প্রকাশে যেমন তিনি অকপট ও সাহসী, তেমনি নারীর প্রতি আকর্ষণ বা মোহকেও লুকোননি। নারীর সৌন্দর্য নয় নারীকে দৈহিকভাবেই তিনি ভেবেছেন এবং সে সব কল্পনা ও পরিকল্পনাকে কবিতা ও কাহিনিতে রূপ দিয়েছেন। প্রসঙ্গত, ব্রাত্য রাইসুর ‘আল মাহমুদ ও জয় গোস্বামীর সঙ্গে আলাপ’ পর্বটি স্মরণ করা যায়। (আর্টস/বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকম, ১৫ নভেম্বর ২০০৭)
আল মাহমুদ নারীকে ভেবেছেন ভূমি; আর পুরুষ সেই জমির চাষি। এইভাবে তিনি সভ্যতাকে, সত্যটাকে সাহিত্যে টেনে এনেছেন। ভাবুকরূপে নারীর রূপকে নান্দনিকতার মোড়ক পরানোর চেয়ে তিনি রক্ত-মাংসের পুরুষ হিশেবে নারীকে পেতে চেয়েছেন জীবনের বাস্তবে ও সাহিত্যের নির্মিতিতে।
এমন সাহস অনেক কবি-সাহিত্যিকই ধারণ করেন না, প্রকাশ তো অনেক পরের কথা। ধর্মবোধ ও চর্চা বিষয়ে ন্যাকামি আল মাহমুদ করেননি। নারীকে নন্দনতত্ত্বের সাবজেক্ট করার ভানও তাঁকে করতে হয়নি। সাহিত্যের অনাগতকালের বাজারে অলিতে ও গলিতে আল মাহমুদকে এইসব পরিচয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাবে নিশ্চয়ই।
কবিতা কিংবা কোনো ক্রিয়েটিভ রচনা কী করে কালের সীমা পেরিয়ে টিকে যায়? এর একটি বড় ধারক হচ্ছে নিজস্ব সংস্কৃতিকে প্রতিপালন করা। বাংলাদেশে বসে যেমন আমেরিকা বা আফ্রিকার জনসমাজ নিয়ে লিখলে বা ছবি আঁকলে তাতে আঁতলামি যুক্ত হবে, তেমনি কানাডায় কিংবা জাপানে বসেও অস্ট্রেলিয়া অথবা ভারতের জীবনকে সাহিত্যে রূপ দেয়া কঠিন যদি না লেখক বা শিল্পী কোনোভাবে ওই জনতা ও প্রতিবেশের সাথে সম্পৃক্ত থাকেন।
আপন ভুবনে বিচরণ করার সামর্থ্য সাহিত্যের ও সাহিত্যিকের থাকতে হয়। আর তা না হলে ওসব রচনা বা শিল্পকর্ম সমকালেই ঝালমুড়ির প্যাকেটে পরিণত হতে বাধ্য। আল মাহমুদ সাহিত্য নিয়ে বারোভাজার হকারি করেননি কখনো। জীবিকার প্রয়োজনে লাইফবয় সাবানের ফেরি করলেও শিল্পের বাজারে কমদানি পোশাক পড়েননি তিনি।
তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই শৈশবে দেখা ছোট কলার বাগান, আটচালা ঘরের ভিটেমাটি, চেনা নদী ও লোকালয়, পরিচিত গ্রাম্য মুখগুলো ঘুরেফিরে তাঁর সাহিত্যের উপাদান হয়ে ঢুকে পড়েছে। জীবনের একটা বিরাট সময় শহরে থেকেও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর যে গ্রাম, কৃষি ও অন্যান্য সৃজনের যে গ্রাম, ঐতিহ্যের শক্তির যে প্রকৃতি, তা তিনি ভোলেননি।
গ্রাম নিয়ে লিখে তিনি গ্রাম্য হয়ে যাননি; গ্রামকে বুকে মাখতে লজ্জাবোধ করতেও দেখা যায়নি। ‘প্রত্যাবর্তনের লজ্জা’ কবিতায় সে-কথার কাহিনী লিখেছেন তিনি।
কবিতা কেমন হতে পারে, কী থাকতে পারে কবিতায়, তার সামান্য তাঁর একটি নির্মিতি থেকে জেনে নেওয়া যেতে পারে ‘কবিতা চরের পাখি, কুড়ানো হাঁসের ডিম, গন্ধভরা ঘাস/ম্লান মুখ বউটির দড়ি ছেঁড়া হারানো বাছুর/গোপন চিঠির প্যাডে নীল খামে সাজানো অক্ষর/কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার।’ (‘কবিতা এমন’)
আর মাহমুদকে যদি সোনালি কাবিনের কবিই মনে করা যায়, তাহলে ভাবতে হবে কী ছিল সেখানে, কী আছে ওখানে? তিনি কি সমাজকে মূল্য দিয়েছেন বেশি, নাকি হৃদয়ের কারবারে মন স্থির রেখেছিলেন? তিনি জানতেন ভালোবাসা ছাড়া আর সব মিথ্যা; আর কিছু কিছু নয়; হৃদয়ের ব্যবসা ছাড়া বড় কোনো বাণিজ্য হতে পারে না।
আর তাই হাজার মানুষের মুখে মুখে স্থান করে নিয়েছে তাঁর সে-কবিতার চরণগুলো; খানিকটা পাঠ নেয়া যেতে পারে ‘সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়ো না হরিণী/যদি নাও, দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দু’টি,/আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনকালে সঞ্চয় করিনি/আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি; বাংলা সাহিত্যের প্রথম জনপ্রিয় এবং এখনো প্রায় ক্রিজে দাঁড়িয়ে থাকা কথাকার শরতের ‘বিলাসী’ গল্পে সোশ্যাল ডকুমেন্টের (কাবিন বা বিবাহ রেজিস্ট্রি) বাইরে নারী-পুরুষের ভালোবাসার সম্পর্কের যে ছবি দেখতে পাওয়া যায়, তাঁর শক্তিসমেত সমূহ মানবিক উপাদান সাজিয়েছেন
আল মাহমুদ তাঁর সোনালি কাবিন-এর কবিতায়।
আল মাহমুদ বাংলা মায়ের সম্ভ্রম-বাঁচানোর সংগ্রামে মেতে-থাকা এক দামাল কবি। প্রায়ই লোকেরা চিনতে ভুল করে; আবার মনে মনে তাঁর কবিতা আওড়ে চলে নিজের অজান্তে ‘আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে/হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে।
এলিয়ে খোঁপা রাত্রি এলেন, ফের বাড়ালাম পা/আমার মায়ের গয়না ছাড়া ঘরকে যাবো না।’ (‘নোলক’) এই কবি পুরো সাহিত্যজীবনে নিজস্ব বিশ্বাসে পরিভ্রমণ করেছেন।
লোকেদের কথায় কান না দিয়ে ব্যক্তির অপার সম্ভাবনা, মানুষের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা আর স্রষ্টার অফুরন্ত নিয়ামতের দিকে দ্বিধাহীন চোখ রেখেছেন। তাই অনেককাল পরও স্বতন্ত্র এক আল মাহমুদের নাম থেকে যাবে শিল্পের করিডোরে।
#লেখকঃ ড. ফজলুল হক সৈকত।
দৈনিক নয়া দিগন্ত।
০৯.০৭.২১
Comments
Post a Comment