LIVITEX
হবিগঞ্জের ছেলে জাকের জাহান ওরফে শুভ্র ঢাকায় এসেছিল নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়তে। পড়া শেষ করে পুরোপুরি থিতু হয়েছেন ঢাকায়। এখন তিনি ঢাকায় বসে আটটি দেশে অনলাইনে হোম টেক্সটাইল বা ঘরের কাজে ব্যবহৃত পণ্য, যেমন বিছানার চাদর, তোয়ালে, কুশনের কভার, লেপ, তোশক ইত্যাদি জোগান দেন। এভাবে তাঁর আয় মাসে প্রায় দেড় কোটি টাকা। অকপটে নিজের পরিচয় দেন, ‘আমি লেপ-তোশকওয়ালা শুভ্র’ হোম টেক্সটাইল বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খুব অভিনব ব্যবসা নয়।
দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশ তৈরি করছে হোম টেক্সটাইলের পণ্য, বিদেশেও রপ্তানি হয় খুব। বিশ্বের বড় হোম টেক্সটাইল ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশ থেকে পণ্য কিনে নেয়। তবে শুভ্রর ব্যবসার অভিনবত্ব হচ্ছে, তিনি পণ্য বিক্রি করেন বাংলাদেশের একটা নিজস্ব ব্র্যান্ডের নামে, ‘লিভিংটেক্স’।
জাকের জাহান ওরফে শুভ্রর সঙ্গে কথা হয় তাঁর উত্তরার অফিসে। পাঁচতলা বাড়ির পুরোটাই লিভিংটেক্সের দখলে। এখানে শুধু পণ্য রাখা এবং অর্ডার প্রস্তুত করা হয়। অর্ডার আসে ভারত, নেপাল, যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। একদল তরুণ চৌকস কর্মী আদেশমাফিক পাঠিয়ে দেন লিভিংটেক্সের পণ্য। কোম্পানির বড় সাহেবের বয়সই মোটে ৩৩ বছর। বাকিরা কেউই ২৮-এর বেশি নন।
জাকের জাহান যখন লিভিংটেক্স শুরু করেন, তাঁর বয়স ২৪ কি ২৫। সে বয়সে অন্য তরুণেরা ছোটেন প্রচলিত চাকরির পেছনে, শুভ্র তখন কীভাবে ভেবেছিলেন ব্যবসায়ই তাঁর ভবিষ্যৎ? ‘আমি খুব খারাপ ছাত্র ছিলাম, বড় স্বপ্নের সাহস করিনি’ সহাস্য জবাব দেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সিজিপিএ খুব ভালো ছিল না, পাস করেই সম্ভব সব জায়গায় চাকরির আবেদন শুরু করলেন। ডাক এল একটি হোমটেক্সটাইল রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান থেকে। এই চাকরিতে ঢুকে চোখ খুলে গেল জাকের জাহান শুভ্রর।
‘প্রতিষ্ঠানটি ঘরের কাজে লাগে এমন সব পণ্য তৈরি করত ঠিকই, কিন্তু পুরাটাই অন্য দেশের ব্র্যান্ডের নামে বিক্রি হতো।’ সিজিপিএ কম হলেও ব্যবসার মূলনীতি ভালোই শিখেছিলেন শুভ্র। হিসাব করে ফেললেন, অন্যের ফরমায়েশি কাজ না করে নিজেদের ব্র্যান্ড হিসেবে বিক্রি করলে মুনাফার হার বেশি থাকে। চাকরিতে বেতন পেতেন মোটে ১৩ হাজার। বের হয়ে গেলেন সেই চাকরি থেকে।
‘এমন না আমার বাবা খুব ধনী। কিন্তু আমার এ সিদ্ধান্তে তিনি পূর্ণ সমর্থন দেন, মানসিক তো বটেই, আর্থিকও।’ বলেন জাকের জাহান শুভ্র। সেই সহযোগিতার বলেই কারখানা কারখানা ঘুরে সংগ্রহ শুরু করেন চাদরের কাপড়। ‘বাসার প্রিন্টারে প্রিন্ট করে ব্র্যান্ডিং করে প্যাকেট করি, এরপর সুপারশপে দেওয়া শুরু করি পণ্য।’
২০১২-১৩ সালে শুভ্র যখন কাজ শুরু করেন, সময়টা অনুকূলেই ছিল বলা যায়। সুপারশপগুলোর পাশাপাশি জীবনযাপনের পণ্যের কিয়স্ক (ছোট দোকান) তৈরি করছিল দেশীয় প্লাস্টিক পণ্যের ব্র্যান্ডগুলো। শুভ্র জুটে যান তাদের সঙ্গে। পালে হাওয়া লাগে লিভিংটেক্সের।
আজ বাজার কোন পথে যাবে, তার পরিকল্পনা তৈরি হয় অন্তত দুই বছর আগে। এখন যে অনলাইনে কেনাকাটার জয়জয়কার, সেটা শুভ্র আন্দাজ করেছিলেন ২০১৫ সালে। ‘আমার কাছে এমনিও আউটলেট নেওয়ার পয়সা ছিল না, ওদিকে তখন নতুন ই-কমার্স সাইটগুলো তৈরি হচ্ছিল। আমিও সেই পথেই এগোলাম।’ বলেন শুভ্র।
অনলাইনে পা দেওয়ায় জীবনের মোড় ঘুরে যায় শুভ্রর। এমনিও আন্তর্জাতিক বাজারে দেশীয় ব্র্যান্ড নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন ছিল, অনলাইনে আসার পর খুব সহজ হয়ে যায় তা।
এক দেশ এক দেশ করে এখন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, মেক্সিকো, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভারত, নেপাল থেকে অনলাইনে অর্ডার করা যায় শুভ্রর লিভিংটেক্সের পণ্য। এ ছাড়া আমাজন, ইবে, নেপালের দারাজ, বাংলাদেশের অনলাইন মার্কেটপ্লেসে আছে পণ্যগুলো। দেশগুলোতে পণ্য পরিবেশক নিয়োগ দেওয়া আছে। একজন ভিনদেশী ক্রেতা স্থানীয় পরিবহণের খরচ দিয়েই কিনতে পারে লিভিংটেক্সের পণ্য। তাই খুব দ্রুতই বাড়ছে ক্রেতার সংখ্যা।
চলতি বছরের মাঝামাঝিতেই শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও পাকিস্তানেও লিভিংটেক্সের সাম্রাজ্য বিস্তারের সম্ভাবনা রয়েছে। আশা করা যায়, বছরের শেষ নাগাদ, প্রতিদিনের অর্ডার সংখ্যা হবে পাঁচ হাজার। আর বিশ্ব জয়ের স্বপ্ন তো আছেই। শুভ্রর আকাঙ্ক্ষা, একদিন বিশ্বের সেসব দেশেই যাবে তাঁর ব্র্যান্ড লিভিংটেক্সের পণ্য।
Comments
Post a Comment